খাদ্যের উচ্চমূল্যে কষ্টে আছে মানুষ

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: চাল ছাড়া অন্যান্য খাদ্যপণ্যে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েই চলেছে। ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে স্বল্প পণ্য আমদানির জন্য চড়া খরচ করতে হচ্ছে সরকারকে। ফলে বাজারে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম। বর্তমানে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ যা শিগগির কমার কোনো লক্ষণও নেই। বাধ্য হয়ে সংসারে খাবারের যোগান দিতে ব্যয় কমিয়ে এনেছে দেশের গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষরা। খাদ্যতালিকা ছোট করেছে অনেকে এবং কম খাচ্ছে তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) দেশে ৬ হাজার ৯৫০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ মূল্যের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৬ শতাংশ কম। ওই অর্থবছরে (২০২১-২২) আমদানির পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ২৫০ কোটি ডলার। তবে আমদানির জন্য গুণতে হয় চড়া খরচ। ফলে গত এক দশকে খাদ্য আমদানি ব্যয় আগের তুলনায় আড়াই গুণ বেড়ে ৮০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। চলতি বছরের আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশে উঠেছিল।

এমন পেক্ষাপটে আজ (১৬ অক্টোবর) সারা বিশ্বের ন্যায় দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস। কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার উদ্যোগে বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচিতে পালিত হচ্ছে দিবসটি। এবারের প্রতিপাদ্য ‘পানি জীবন, পানিই খাদ্য-কেউ থাকবে না পিছিয়ে।’

খাদ্যের মূল্যস্ফীতি যখন অসহনীয়, তখন বরাবরের মতো খাদ্য উৎপাদনে বিস্ময়কর সাফল্যের দাবি করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। রোববারও (১৫ অক্টোবর) এক বিবৃতিতে মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘বিগত ১৫ বছরে খাদ্য উৎপাদনে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জিত হয়েছে।’

কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পর এখন উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০০৮-০৯ সালে যেখানে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার টন, সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে ৪ কোটি ৭৭ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য ফসলের উৎপাদনেও ধারাবাহিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বিগত ১৫ বছরে ভুট্টা উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে প্রায় ৯ গুণ, আলু ২ গুণ, ডাল ৪ গুণ, তেল বীজ ২.৫ গুণ ও সবজি ৮ গুণ। বর্তমানে বাংলাদেশের ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে, যেমন, ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, চা উৎপাদনে চতুর্থ এবং আলু ও আম উৎপাদনে সপ্তম।

প্রধান খাদ্য শস্যের মধ্যে চালের উৎপাদন ক্রমাগত বেড়ে ২০০৮-০৯ সালের ৩ কোটি ১৩ লাখ টন এখন (২০২২-২৩) সালে ৪ কোটি টনেরও বেশি হয়েছে। এছাড়া ২০০৮-০৯ সালে গমের উৎপাদন ছিল ৮ লাখ ৪৯ হাজার টন ২০২২-২৩ সালে ১১ লাখ ৭০ হাজার টন হয়েছে। পাশাপাশি ওই সময় ভুট্টা ছিল ৭ লাখ টন যা এখন ৬৪ লাখ টন উৎপাদন হচ্ছে। একই সময়ে আলু ৫ লাখ টন থেকে বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ, সবজি ৩০ লাখ টন থেকে বেড়ে হয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ টন।

কম খাচ্ছে মানুষ
যেখানে কৃষি মন্ত্রণালয় ঢের সাফল্যের কথা বলছে, সেখানে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) জরিপের তথ্য বলছে, মানুষ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বাজারে দিনের পর দিন জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকায় খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলেছে নিম্নআয়ের মানুষ। তারা কম খাচ্ছে। ছয় মাসে (সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত) ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছে। ৮৮ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার মাছ কম খাচ্ছে।

সানেমের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নিম্নআয়ের পরিবারে খরচ বেড়েছে গড়ে ১৩ শতাংশ। এ সময় তাদের আয় বাড়েনি। বাধ্য হয়ে অনেক পরিবার খাবারের গুণগত মানেও ছাড় দিচ্ছে। অর্থাৎ আগের চেয়ে কম দামের খাবার কিনে খাচ্ছে। সারাদিন না খেয়ে থাকছে, এমন দরিদ্র মানুষের হার ১৮ শতাংশ।

খাদ্যের উচ্চমূল্যে কষ্টে আছে মানুষ
দেশের আট বিভাগের নিম্নআয়ের এক হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর জরিপ করেছিল সানেম। পরে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাছ-মাংস ছাড়াও অন্যান্য খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রেও লাগাম টেনেছে দরিদ্র মানুষ। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম ও ৮১ দশমিক ৪৩ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়েছে। প্রায় ৪৬ শতাংশ পরিবার ডাল, ৫৭ শতাংশ পরিবার আটা ও ৩৭ শতাংশ পরিবার ভাত কম খাচ্ছে।

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সংস্থটির নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ওই সময়ের থেকে (চলতি বছরের শুরুর দিক) এখন আরও খরচ বেড়েছে। সে সময়-ই আমরা দেখেছি দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে যে, বেশিরভাগ নিম্নআয়ের পরিবার ঋণ করে চলছে, এখন পরিস্থিতি আরও কঠিন। বাড়তি আয় নেই বলে এখন অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। যাদের সে সুযোগ নেই এমন মানুষ আরও বিপদে রয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা দেখেছি, সংসারে খরচ বেড়ে যাওয়ায় খাওয়ার পাশাপাশি পরিবারগুলো স্বাস্থ্ খাতে ব্যয়ে কাটছাঁট করছে। অনেকে জমি বিক্রি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া আমিষে কাটছাঁটের কারণে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে। এসব সমস্যা দীর্ঘমেয়াদী।

এমন জরিপের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কথা হয় অনেকের সঙ্গে। তারা বলছেন, সংসারের খাদ্যের ব্যয় নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছেন। একই সময়ে মানুষের আয় যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হারে বাড়ছে তাদের খরচ। বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষ যা আয় করছে, সবই খাদ্যপণ্য কিনতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।

রাজধানীর রামপুরা এলাকায় দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করেন রুবি আক্তার। তিনি বলেন, গরু-খাসির মাংস অনেক আগেই কেনা বাদ দিয়েছি। এখন ডিম-দুধও খাওয়া যাচ্ছে না। গত মাসে মেয়ের টিউশনি কমিয়ে দিয়েছি। এভাবে আরও কয়েকমাস চললে যে বাসায় থাকছি, সেটাও ছাড়তে হবে। কম ভাড়ার বাসা খুঁজতে হবে। তিনি আরও বলেন, দ্রব্যমূল্যের কারণে মাসের শেষে ঋণ করতে হচ্ছে। সেটা পরিশোধ করতে সঞ্চয় ভাঙতে হয়েছে গত মাসে। এভাবে চলতে থাকলে গ্রামে ফিরে যেতে হবে।

সমাধানে যা বলছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা
শুধু বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক, বিষয়টা এমন নয়। বিশ্বের বেশকিছু দেশ এ সমস্যার মধ্যে রয়েছে। তবে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা বা আর্জেন্টিনার মতো এখনও গভীর সংকটে থাকা কিছু দেশ ছাড়া অন্যরা মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছে। যদিও দেশে শিগগির খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতির নীতি অনুসরণ করলেও অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে মনোযোগ দেওয়া উচিত। তা না করলে করোনা মহামারি ও ডলার সংকটের মতো অবস্থা যেকোনো সময় আবারও পরিস্থিতি নাজুক করতে পারে। আমাদের আমদানি ব্যয় কমানোর বিকল্প নেই। আমাদের উচিত খাদ্যপণ্য উৎপাদন অগ্রাধিকার দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা।

পাশাপাশি বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, আমদানি নির্ভরতা বাড়ার পরেও ডলার সংকটে পণ্য আমদানি কমেছে গত অর্থবছর। তাতে স্বাভাবিকভাবে যতটুকু সংকট তৈরি হয়েছে, এর চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে পণ্য মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা। আমদানি কমার সংকটকে কাজে লাগিয়ে অনৈতিকভাবে পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রবণতা রয়েছে ব্যবসায়ীদের। এছাড়া আছে সিন্ডিকেটের প্রভাব।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের স্বাভাবিক সময়ের মতো আমদানি করার সামর্থ্য নেই, এটা সত্য। সার্বিক রিজার্ভ কমেছে এসময়, অনেক পাওনা রয়েছে যেগুলো অপরিশোধিত, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে পণ্য আমদানি সাশ্রয় হ্রাস একটি বড় কৌশল।

তিনি বলেন, আমদানি কমে যাওয়া খাদ্য মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ। এর মধ্যে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি আমদানি কমায় ভোক্তারা পণ্যের দামের চাপে পড়ছে। আবার যতটুকু মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি হয়েছে, এর চেয়ে বেশি বাজারে সিন্ডিকেট করে অনৈতিক সুবিধা নেওয়া হচ্ছে। যতটুকু প্রকৃত চাপ রয়েছে, তার চেয়ে বাড়তি চাপ দেখানো হচ্ছে। জাগো নিউজ।